চেক ডিজঅনার (চেক বাউন্স): আইন, মামলা ও করণীয় গাইড
ব্যবসা ও আর্থিক লেনদেনে চেক একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। কিন্তু কোনো কারণে চেক বাউন্স বা ডিজঅনার হলে তা শুধু আর্থিক ক্ষতির কারণ নয়, বরং আইনি জটিলতারও সৃষ্টি করে। এই লেখায় আমরা চেক ডিজঅনারের কারণ, প্রযোজ্য আইন, মামলা করার প্রক্রিয়া এবং করণীয় বিষয়গুলো বিস্তারিত আলোচনা করব।
চলুন যেনে নেওয়া যাক "চেক ডিজঅনার (চেক বাউন্স): আইন, মামলা ও করণীয় গাইড" সম্পর্কে বিস্তারিত।
ভূমিকা
বর্তমান আর্থিক লেনদেনের যুগে চেক একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং নির্ভরযোগ্য পেমেন্ট মাধ্যম। কিন্তু অনেক সময় চেক প্রদানের পর ব্যাংকে জমা দিলে একাউন্টে অপর্যাপ্ত থাকার কারণে সেটি “ডিজঅনার” হয়ে যায়। অর্থাৎ, ব্যাংক চেকটি পরিশোধ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এই চেক ডিজঅনার একটি আইনগত অপরাধ এবং এর জন্য দোষী ব্যক্তিকে সাজাও হতে পারে।
আধুনিক আর্থিক লেনদেনে চেক একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বহুল ব্যবহৃত মাধ্যম। ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি, ব্যবসা থেকে ব্যবসা কিংবা সংস্থার মধ্যে চুক্তিভিত্তিক অর্থ লেনদেনে চেকের ব্যবহার দীর্ঘদিন ধরেই প্রচলিত। তবে, কখনও কখনও এই চেক নির্ধারিত অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হয়, যাকে বলা হয় চেক ডিজঅনার বা চেক প্রত্যাখ্যান। এটি কেবল একটি ব্যাংকিং সমস্যা নয়, বরং একটি গুরুতর আইনি অপরাধ হিসেবেও বিবেচিত।
চেক ডিজঅনার ঘটে যখন ব্যাংকে চেকটি জমা দেওয়ার পর, ব্যাংক কোনো নির্দিষ্ট কারণে তা নগদায়ন করতে অস্বীকার করে। সবচেয়ে সাধারণ কারণ হলো চেকদাতার অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা না থাকা। এছাড়াও ভুল স্বাক্ষর, চেকের মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়া, একাউন্ট বন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা কারিগরি ত্রুটির কারণেও ডিজঅনার ঘটতে পারে।
বাংলাদেশে চেক ডিজঅনার সংক্রান্ত আইন মূলত হস্তান্তরযোগ্য দলিল আইন বা নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টস অ্যাক্ট, ১৮৮১-এর ধারা ১৩৮ অনুসারে পরিচালিত হয়। এই ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে এমন একটি চেক ইস্যু করেন, যা ব্যাংক পরিশোধ করতে অস্বীকার করে, তাহলে তা একটি দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এই অপরাধের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তি সর্বোচ্চ এক বছর কারাদণ্ড অথবা চেকের তিন গুণ পর্যন্ত জরিমানা কিংবা উভয় শাস্তির সম্মুখীন হতে পারেন।
চেক ডিজঅনারের ঘটনা শুধুমাত্র আর্থিক ক্ষতির কারণই নয়, এটি ব্যক্তিগত ও পেশাগত সম্মান ক্ষুন্ন করে এবং আইনগত হয়রানির দিক থেকেও অত্যন্ত জটিল একটি পরিস্থিতি তৈরি করে। এ কারণে এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে সচেতনতা, সতর্কতা এবং আইনি জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এই প্রবন্ধে আমরা চেক ডিজঅনারের কারণ, আইনি প্রক্রিয়া, সম্ভাব্য শাস্তি এবং এ ধরনের সমস্যা মোকাবিলার করণীয় বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। উদ্দেশ্য হলো, ব্যক্তি ও ব্যবসায়ী উভয়কেই চেক লেনদেনের ক্ষেত্রে আরও সচেতন ও দায়িত্বশীল করে তোলা, যাতে অর্থনৈতিক লেনদেন নিরাপদ এবং আইনানুগ হয়।
চেক ডিজঅনার কী?
চেক ডিজঅনার মানে হলো, চেকটি যখন ব্যাংকে জমা দেওয়া হয়, তখন কোনো কারণে ব্যাংক তা সম্মান জানায় না বা অর্থ প্রদান করে না। ব্যাংক সাধারণত “insufficient fund” বা “অপ্রতুল অর্থ”, “signature mismatch” বা “স্বাক্ষরের মিল নেই”, কিংবা “account closed” এই ধরণের কারণে চেক ফেরত দেয়।
চেক ডিজঅনারে আইনি পদক্ষেপ
বাংলাদেশে চেক ডিজঅনার সংক্রান্ত মামলা মূলত ১৮৮১ সালের নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্টস অ্যাক্ট এর ধারা ১৩৮ অনুসারে দায়ের করা হয়।
আইনি শর্তাবলি যা অবশ্যই পূরণ করতে হবে:
- চেকটি অবশ্যই ঋণ বা দায় পরিশোধের জন্য ইস্যু হতে হবে।
- চেক ডিজঅনার হওয়ার পর ৩০ দিনের মধ্যে প্রাপককে লিগ্যাল নোটিশ দিতে হবে।
- নোটিশ পাওয়ার পর ৩০ দিনের মধ্যে অর্থ পরিশোধ না করলে, প্রাপক আদালতে মামলা করতে পারবেন।
- মামলা করতে হবে চেক ডিজঅনারের ৬ মাস এর মধ্যে।
চেক ডিজঅনারের শাস্তি
ধারা ১৩৮ অনুযায়ী, দোষী প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে হতে পারে—
- সর্বোচ্চ এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড, অথবা
- চেকের তিন গুণ পর্যন্ত জরিমানা, অথবা
- উভয়ই।
চেক ডিজঅনার (Dishonour) – আইন এবং প্রক্রিয়া
১. ধারা ১৩৮: চেক ডিজঅনার (অর্থপ্রদানব্যর্থতা)
ধারা ১৩৮ অনুসারে:
যদি কোনো ব্যক্তি তার ব্যাংক একাউন্ট থেকে অন্য ব্যক্তিকে অর্থ পরিশোধের জন্য চেক দিয়ে থাকলেও, ব্যাংক সেটি ফেরত দেয়—যদি:
- অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত টাকা না থাকে, বা
- ব্যাংকের সাথে সম্মতির বাইরে অর্থ উত্তোলনের চেষ্টা করা হয়
তাহলে ঐ ব্যক্তিকে অপরাধী ধরা হবে।
আইন অনুযায়ী তাকে হতে পারে:
- সর্বোচ্চ এক বছর কারাদণ্ড, অথবা
- চেকের পরিমাণের সর্বোচ্চ তিন গুণ জরিমানা, অথবা
- উভয় শাস্তি একসাথে
২. শর্তগুলো যা সম্মতি পেতে হবে
এই শাস্তিমূলক ধারা কার্যকর হতে হলে নিম্নলিখিত শর্ত পূরণীয়:
- চেক ৬ মাসের মধ্যে (বা তার সময়সীমার ভিতরে) ব্যাংকে জমা দিতে হবে
- ডিজঅনার হওয়ার পরে ৩০ দিনের মধ্যে লিখিতভাবে আইনজীবীর মাধ্যমে লিগ্যাল নোটিশ দিতে হবে চেক ইস্যুকারকে
- নোটিশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে অর্থ পরিশোধ না করলে মামলা দায়ের করতে পারবেন প্রাপক
৩. নোটিশ প্রদানের উপায় (ধারা ১৩৮(১এ))
লিগ্যাল নোটিশ নিম্নপন্থায় পরিবেশিত হতে পারে:
- সরাসরি ব্যক্তি হাতে হস্তান্তর করে,
- রেজিস্টার্ড পোস্টের মাধ্যমে স্বীকৃতিসহ, অথবা
- দৈনিক একটি জনপ্রিয় বাংলা পত্রিকায় প্রকাশ করে
৪. কোম্পানির ক্ষেত্রেও দায়
যদি একটি কোম্পানি চেক ডিজঅনার করে, তাহলে ধারা ১৪০ অনুসারে:
- সেই কোম্পানি এবং
- সেই কোম্পানির পরিচালক, ব্যবস্থাপক বা যেকোনো নিয়ন্ত্রক বা দায়িত্বরত ব্যক্তিও দায়ী হতে পারে
৫. জামিন ও আপীল সম্পর্কিত শর্ত
আপনি যদি মামলার রায়ের পরবর্তিতে আপীল দায়ের করতে চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই ফাইনাল রায়ের ৫০% চেক এ উল্লেখিত অর্থ বা তার বেশি আমানত হিসেবে যে আদালত রায় দিয়েছে সেই আদালতে জমা রাখতে হবে।
৬. করণীয় ধাপগুলো – ধাপে ধাপে নির্দেশিকা
| ধাপ | করনীয় |
|---|---|
| ১. চেক জমা দিন | ৬ মাসের ভেতরে (বা বৈধতার মধ্যে) |
| ২. ডিজঅনারের প্রমাণ সংগ্রহ করুন | ব্যাংক থেকে লিখিত কারণসহ |
| ৩. নোটিশ পাঠান | আইনজীবীর মাধ্যমে লিগাল নোটিশ পাঠান ৩০ দিনের মধ্যে, রেজিস্টার্ড পোস্ট/ব্যক্তিগতভাবে/পক্ষিকার মাধ্যমে |
| ৪. নোটিশ প্রদানের ৩০ দিনের মধ্যে অর্থ না পেলে মামলা করুন | আদালতে |
৭. শাস্তির পরিমাণ এবং প্রভাব
যদি দোষ প্রমাণিত হয়:
- কারাদণ্ড: সর্বোচ্চ এক বছর, অথবা
- জরিমানা: চেকের পরিমাণের সর্বোচ্চ তিন গুণ, অথবা
- উভয় শাস্তি একসঙ্গে
চেক ডিজঅনার প্রতিরোধে কিছু পরামর্শ
- চেক দেওয়ার আগে আপনার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত অর্থ আছে কি না, তা নিশ্চিত করুন।
- চেকের তারিখ, পরিমাণ ও স্বাক্ষর সঠিকভাবে পূরণ করুন।
- কারো চেক গ্রহণ করার সময় চেকের তারিখ, স্বাক্ষর, এবং লেখার ভুল না আছে কি না তা ভালোভাবে দেখে নিন।
- কাউকে কখনো ব্লাঙ্ক চেক দিবেন না।
- সবসময় লেনদেনের রশিদ বা লিখিত প্রমাণ রাখুন।
উপসংহার
চেক ডিজঅনার বাংলাদেশের আইনে একটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। চেক জমা দেওয়ার পর ব্যাংক থেকে ফেরত আসলে—হোক তা অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত অর্থের অভাব, স্বাক্ষর না মেলা, তারিখের ভুল, কিংবা অ্যাকাউন্ট বন্ধ থাকা—এই ক্ষেত্রে আইনগতভাবে নোটিশ পাঠিয়ে মামলা করা সম্ভব। আইন অনুযায়ী এই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বৈধ হলে প্রতিপক্ষকে জেল বা জরিমানার মুখোমুখি হতে হয়। তাই চেক লেনদেনে সর্বদা সতর্ক থাকা অত্যন্ত জরুরি।
চেক ডিজঅনার শুধু আর্থিক ক্ষতির কারণ নয়, এটি একজন ব্যক্তির সম্মান ও বিশ্বাসযোগ্যতার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই ব্যবসায়িক কিংবা ব্যক্তিগত প্রয়োজনে চেক ব্যবহারের সময় সচেতন থাকা প্রয়োজন। যদি আপনি চেক ডিজঅনারের মামলা করতে চান বা এমন মামলার আসামি হন, তাহলে দেরি না করে একজন অভিজ্ঞ আইনজীবীর পরামর্শ নিন এবং লিগ্যাল নোটিশ ও মামলা প্রক্রিয়া সম্পর্কে সঠিকভাবে জানুন।
লেখক-
মাসরুর আব্দুল্লাহ আবিদ
প্রভাষক
আইন ও মানবাধিকার বিভাগ
বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়
চেক ডিজঅনার (চেক বাউন্স): আইন, মামলা ও করণীয় গাইড" বিষয়ে আপনার মতামত কী? নিচের মন্তব্যে আপনার অভিজ্ঞতা বা প্রশ্ন জানাতে পারেন। আপনার প্রতিটি মন্তব্য আমাদের কনটেন্টকে আরও সমৃদ্ধ করবে।
ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো।

সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url