শিশুশ্রম ও তার প্রতিকার রচনা

শিশুশ্রম ও তার প্রতিকার রচনা এই বিষয়ে বলতে গেলে প্রথমে আমাদের মাথায় যা আসে তাহল, ৫-১৫ বছর বয়সী শিশুরা যারা বেতন বা অবৈতনিক উভয় ক্ষেত্রে বিভিন্ন জাইগায় কায়িক প্ররিশ্রম করে থাকে। আজকের আলোচনায় এইসব শিশুদের নিয়ে রচনা করা হয়েছে।
শিশুশ্রম ও তার প্রতিকার রচনা
চলুন যেনে নেওয়া যাক "শিশুশ্রম ও তার প্রতিকার রচনা" সম্পর্কে বিস্তারিত। 

ভূমিকা

শিশুশ্রম সমাজের একটি জটিল সমস্যা যা শিশুদের স্বাভাবিক বিকাশ ও ভবিষ্যৎকে বাধাগ্রস্ত করে। এর বিভিন্ন ধরণ রয়েছে, যেমন গৃহকর্ম, কলকারখানায় কাজ এবং রাস্তার ব্যবসা। 

শিশুশ্রম ও তার প্রতিকার রচনা বিষয়ক আলোচনায় আজকে  শিশুশ্রম কি, শিশুশ্রমের ধরণ, শিশুশ্রমের ইতিহাস, শিশু শ্রমের কারন, বাংলাদেশে শিশুশ্রম, বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকের জীবনমান, বাংলাদেশে শিশুশ্রমেরে কারণ, শিশুশ্রম রোধ করা প্রয়োজন কেন এবং শিশুশ্রমের এর প্রতিকার সম্পরকে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। 

১. শিশুশ্রম কি

শিশুশ্রম হলো শিশুদেরকে তাদের বয়সের তুলনায় কঠোর, ঝুঁকিপূর্ণ বা অনিরাপদ কাজের মধ্যে নিয়োজিত করা যা তাদের স্বাভাবিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। সাধারণত নির্দিষ্ট বয়সের নিচে (প্রায় ১৪-১৫ বছর) শিশুদের কর্মসংস্থান আইনত নিষিদ্ধ করা হয়েছে, কারণ এ ধরনের কাজ তাদের শারীরিক, মানসিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। 

শিশুশ্রমের ফলে শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় এবং ভবিষ্যতে সুস্থ, শিক্ষিত ও দক্ষ নাগরিক হয়ে ওঠার সুযোগ হারায়। শিশুশ্রম আইনত কম বয়সী শিশুদের কাজ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও অনেক দেশেই এই সমস্যাটি বিদ্যমান। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে পারিবারিক দারিদ্র্য এবং শিক্ষার অভাবে শিশুশ্রমের ব্যাপকতা বেশি। 

১৮ শতকের শেষের দিকে ব্রিটেনে শিশুদের কারখানার কাজে নিয়োগের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন শুরু হলেও কার্যকর প্রয়োগের অভাবে তা সফল হয়নি। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) ১৯৯২ সালে শিশুশ্রম নির্মূলের জন্য আইপিইসি চালু করে যা শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে এনে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কাজ করছে। 

তবুও, এখনো অনেক দেশে শিশুদের নিরাপদ কর্ম পরিবেশ ও শিক্ষার সুযোগ দিতে আইনের কার্যকর প্রয়োগ প্রয়োজন।

২. শিশুশ্রমের ধরণ

শিশুশ্রম বলতে এমন শ্রমকে বোঝায় যেখানে শিশুদের তাদের স্বাভাবিক শৈশব এবং শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের শ্রমে নিয়োজিত করা হয়। 
শিশুশ্রম রচনা
বাংলাদেশে শিশুশ্রমের বিভিন্ন ধরণ রয়েছে, যা প্রধানত দুটি খাতে বিভক্ত-
  • আনুষ্ঠানিক এবং 
  • অনানুষ্ঠানিক। 

২.১. আনুষ্ঠানিক খাত 

এ খাতে কারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, যোগাযোগ এবং পরিবহন এবং শিপ ব্রেকিং শিল্প অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এসব স্থানে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ থাকলেও, অনেক শিশুকে কম মজুরিতে এবং কখনও কখনও দৈহিক ও মানসিক ক্ষতির ঝুঁকিতে দীর্ঘ সময় কাজ করতে বাধ্য করা হয়​। গার্মেন্টস শিল্পে শিশুদের শ্রম ব্যবহারের ঘটনা লক্ষ্য করা যায়। 

গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে শিশু শ্রমিকরা প্রায়ই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করে, যেখানে তারা অতিরিক্ত সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য হয় এর ফলে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক ক্ষতির ঝুঁকি থাকে এবং তারা অপর্যাপ্ত পারিশ্রমিক পায়। অনেক ক্ষেত্রে, এই শ্রমিকরা দিনপ্রতি দশ ঘণ্টারও বেশি কাজ করতে বাধ্য হয় এবং তারা আগুন ও অন্যান্য দুর্ঘটনার ঝুঁকির মধ্যে থাকে।

২.২. অনানুষ্ঠানিক খাত 

এ খাতে কৃষি, গবাদিপশু পালন, মাছ ধরা, গৃহস্থালী কাজ, নির্মাণ কাজ, ইট ভাঙা, রিকশা বা ভ্যান চালানো এবং দিনমজুরির মতো কাজ অন্তর্ভুক্ত। এছাড়া অনেক শিশু পথশিশু হিসেবেও বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত হয়। এ ধরণের শ্রমে শিশুদের নিরাপত্তাহীন ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে দীর্ঘ সময় কাজ করতে হয় যা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাজীবনের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। 

বাংলাদেশে কৃষি ক্ষেত্রে শিশুশ্রম বেশ প্রচলিত, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে। কৃষি খাতে শিশুরা প্রায়ই ফসল সংগ্রহ, মাছ শুকানো এবং গবাদিপশুর যত্ন নেওয়ার মতো কাজে নিয়োজিত হয়। এ কাজগুলোতে শিশুদের দীর্ঘ সময় ধরে কষ্ট করতে হয় এবং এর সাথে বিপজ্জনক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের ঝুঁকিও থাকে যা তাদের স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।​ 

গৃহস্থালি কাজে শিশু শ্রমিকদের নিয়োজিত করা হয় যা বিশেষত শহরাঞ্চলে সাধারণ একটি প্রথা। এসব শিশুদের অধিকাংশই দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে এবং এদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এ ধরনের কাজ তাদের মানসিক চাপ বৃদ্ধি করে এবং স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশে শিশুশ্রমের সমস্যা সমাধানে বেশ কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও, দরিদ্রতা, শিক্ষার অভাব এবং সমাজের সচেতনতার অভাবে এই সমস্যা পুরোপুরি দূর করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে দারিদ্র্য এবং শিক্ষার অভাবের কারণে শিশুদের শ্রমে নিয়োজিত হওয়ার প্রবণতা রয়েছে। 

UNICEF-এর তথ্য অনুসারে, প্রায় ৫০% শিশুশ্রমিক স্কুলে উপস্থিত থাকে না এবং তাদের শিক্ষা জীবনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। এভাবে শিশুশ্রমের মাধ্যমে শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় এবং তাদের স্বাভাবিক জীবন থেকে অনেক দূরে সরে যায়। এই শিশুশ্রমের কারণে শিশুদের সার্বিক বিকাশে ক্ষতি হয় এবং এটি তাদের সুস্থ ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার পথে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।

৩. শিশুশ্রমের ইতিহাস

শিশুশ্রম ও তার প্রতিকার রচনা লিখতে গেলে গুরুত্বপূর্ণ হয় এর ইতিহাস সম্পর্কে জানা। এর ইতিহাস সম্পর্কে বলতে গেলে কয়েক ধাপে বলতে হবে, যেমন-

৩.১. প্রাক ইন্ডাস্ট্রিয়াল সোসাইটি

প্রাক-শিল্প সমাজে শিশুশ্রম একটি স্বাভাবিক এবং অপরিহার্য অংশ ছিল যেখানে শিশুরা কম বয়স থেকেই পরিবারের বিভিন্ন কাজে অংশ নিতো। তখনকার সমাজে শৈশবের স্বতন্ত্র ধারণা তেমন ছিল না, তাই ১৩ বছরের কম বয়সী শিশুদেরও প্রাপ্তবয়স্কদের মতোই পরিণত হিসেবে গণ্য করা হতো। 

শিশুদের কাজ করা জীবনের অপরিহার্য অংশ ছিল কারণ এটি তাদের পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় বেশিরভাগ জ্ঞান ও দক্ষতা সরাসরি শিক্ষানবিশের মাধ্যমে অর্জন করা হতো যা সেই সময়ের জন্য উপযোগী ছিল। 

প্রাক-শিল্প যুগে শিশুশ্রম ছিল সমাজের একটি মূল ও প্রয়োজনীয় অংশ, বিশেষত কৃষিভিত্তিক এবং স্বল্প-উৎপাদনশীল অর্থনীতির মধ্যে। এই সময়ে, আধুনিক যুগের মতো আলাদা শৈশব ধারণা বিদ্যমান ছিল না। শিশুরা প্রায়শই তরুণ বয়স থেকেই পরিবারের কাজ এবং অর্থনৈতিক দায়িত্ব পালনে যুক্ত হত।

প্রাক-শিল্প সমাজগুলোতে অধিকাংশ মানুষ কৃষিকাজ, পশুপালন এবং ছোট কারিগরি কাজের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করত। শিশুরা পরিবারকে সহায়তা করার জন্য শৈশব থেকেই এই কাজে অংশগ্রহণ করতো। দরিদ্র পরিবারগুলোতে শিশুদের শ্রম পারিবারিক আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হতো। 

তাই, শৈশবকাল থেকেই তারা কঠোর পরিশ্রমের সঙ্গে জড়িত থাকত। শিশুরা ফসল সংগ্রহ, পশুপালন এবং হস্তশিল্পের বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত থাকত এবং তাদের কাজের মাধ্যমে পরিবার এবং সমাজকে অর্থনৈতিকভাবে সহায়তা করত।

এই সময়ের সমাজে শিক্ষা ব্যবস্থা খুবই সীমিত ছিল এবং প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ ছিল না। জ্ঞান ও দক্ষতা অর্জন করার জন্য শিশুরা প্রায়ই শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করত এবং সরাসরি যোগ্য প্রাপ্তবয়স্কদের কাছ থেকে কাজ শিখত। এই পদ্ধতিতে শিশুরা তাদের পারিবারিক এবং সামাজিক দায়িত্ব পালন করত এবং ভবিষ্যতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করত।

প্রাক-শিল্প সমাজের নিম্ন উৎপাদনশীলতা এবং অল্প আয়ু বিবেচনায় শিশুশ্রম একটি প্রয়োজনীয় অংশ ছিল কারণ পরিবারের প্রতিটি সদস্যের উৎপাদনমূলক অবদান ছিল তাদের কল্যাণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৩.২. শিল্প বিপ্লব

১৮ শতকের শেষের দিকে শিল্প বিপ্লব শুরু হওয়ার পর, ব্রিটেনের মতো দেশগুলোতে শিশুশ্রম ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। দ্রুত শিল্পায়নের ফলে ছোট গ্রামগুলো বার্মিংহাম, ম্যানচেস্টার, লিভারপুলের মতো শিল্প শহরে পরিণত হয়। নতুন শিল্পগুলোতে সস্তা শ্রমের চাহিদা বেড়ে যায় এবং শিশুদের কঠোর ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়।

৩.২.১. ঝুঁকিপূর্ণ কাজের পরিবেশ

কারখানা ও খনিতে শিশুদের দীর্ঘ সময় ধরে বিপজ্জনক অবস্থায় কাজ করতে হতো যেমন সরু টানেল দিয়ে হামাগুড়ি দেওয়া, পণ্য তৈরিতে সহায়তা ও ছোটখাটো জিনিসপত্র বিক্রি করা। অনেক সময় মাত্র চার বছরের শিশুদের এই কঠিন কাজগুলো করতে বাধ্য করা হতো, যেখানে শিশুমৃত্যুর হারও ছিল উচ্চ।

ভিক্টোরিয়ান যুগে শিশুদের কাজে নিযুক্তকরণের শর্ত ছিল অত্যন্ত কঠোর এবং তাদের জন্য নির্ধারিত মজুরি একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের মজুরির ১০-২০% এর সমান ছিল। অর্থনৈতিক কষ্টে দরিদ্র পরিবারের শিশুদের আয়ে অবদান রাখা বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে, কারণ অনেক পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী না থাকায় শিশুদের কাজ করতে হত।

৩.২.২. আইনি পদক্ষেপ ও নিয়ন্ত্রণ

শিল্প বিপ্লবের প্রথম দিকে শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন পাস হয় যেমন ১৮০২ সালের কারখানা আইন যা তুলা কারখানায় শিশুদের দৈনিক কাজের সময় ১২ ঘণ্টা সীমিত করে। পরবর্তীতে ১৮৩৩ সালে রয়্যাল কমিশন কর্তৃক সুপারিশ করা হয় যে, ১১ থেকে ১৮ বছর বয়সীদের জন্য ১২ ঘণ্টার এবং ৯ থেকে ১১ বছর বয়সীদের জন্য ৮ ঘণ্টার কর্মসময় নির্ধারণ করা উচিত।

তবে প্রাথমিক আইনগুলো কার্যকর না হওয়ায়, পরবর্তী আন্দোলন ও কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী ১৮৪৭ সালে প্রাপ্তবয়স্ক ও শিশুদের জন্য ১০ ঘণ্টার কর্মদিবস নির্ধারণ করা হয়। লর্ড শ্যাফটসবেরি শিশু শ্রম নিয়ন্ত্রণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

৩.২.৩. প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও শিশুশ্রমের পতন

প্রযুক্তিগত উন্নতি এবং শিক্ষার প্রসারের সাথে শিশুশ্রম কমতে থাকে। বাধ্যতামূলক স্কুলিং এবং স্বয়ংক্রিয় মেশিনের ব্যবহার শিশুশ্রমের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে, বিশেষত পশ্চিম ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে নতুন আইন শিশুশ্রমকে সীমিত করে। 

বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিশুশ্রমের উপর আরো কঠোর আইন প্রবর্তিত হয়,যা আধুনিক শিল্প সমাজে শিশুশ্রমের পতন ঘটায়।

এই যুগের শিশুশ্রমের ইতিহাস দেখায় যে শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে শিশুদের প্রতি শোষণ বেড়ে যায় এবং পরবর্তীতে আইনি পদক্ষেপ ও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটে।

৩.৩. ২০ শতকের গোড়ার দিকে

বিশ শতকের শুরুতে কাঁচ তৈরির শিল্পে হাজার হাজার শিশুশ্রমিক নিযুক্ত ছিল। প্রযুক্তিগত সুবিধা ছাড়া, গ্লাস তৈরি ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং জটিল। এই প্রক্রিয়ায় 3,133 °F (1,723 °C) পর্যন্ত তীব্র তাপের প্রয়োজন হয় যা শিশু শ্রমিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টি করত। 

কর্মক্ষেত্রে এই উত্তাপে কাজ করার ফলে তাদের চোখে সমস্যা, ফুসফুসের রোগ, তাপ ক্লান্তি, কাটা এবং পোড়া মতো শারীরিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো। শ্রমিকরা টুকরো সংখ্যার ভিত্তিতে পারিশ্রমিক পেত যার ফলে বিরতি ছাড়াই দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করতে হতো। চুল্লিগুলি সার্বক্ষণিক চালু রাখার কারণে বিকাল ৫টা থেকে ভোর ৩টা পর্যন্ত রাতের শিফটে কাজ করা ছিল সাধারণ। 

অধিকাংশ কারখানার মালিক ১৬ বছরের কম বয়সী ছেলেদের কাজে নিয়োগ দিতে বেশি আগ্রহী ছিলেন। ১৯০০ সালে, আনুমানিক ১.৭ মিলিয়ন শিশু আমেরিকান শিল্পে কাজ করত যার মধ্যে পনের বছরের কম বয়সী শিশুর সংখ্যাই বেশি। ১৯১০ সালে, এই সংখ্যা বেড়ে ২ মিলিয়ন ছাড়িয়ে যায়। 

এই শিশুদের অনেকে কারখানায়, কয়লা খনিতে, ববিন ডফার হিসেবে টেক্সটাইল মিলে এবং ক্যানেরিতে কাজ করত। তারা সিগারেট বানানো বা বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করার মতো কঠিন কাজে নিয়োজিত ছিল। লুইস হাইনের তোলা ছবিগুলো ১৯১০-এর দশকে দক্ষিণ আমেরিকার শিশু শ্রমিকদের অবর্ণনীয় কষ্টের চিত্র ফুটিয়ে তোলে। 

১৯০৮ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে জাতীয় শিশু শ্রম কমিটির পক্ষ থেকে তিনি এই গুরুত্বপূর্ণ ছবিগুলো তুলেছিলেন।

৩.৩.১. গৃহস্থালীর কার্যক্রমে শিশুশ্রম 

বিশ শতকের গোড়ায় শিশুশ্রম শুধু কারখানা বা খনিতে সীমাবদ্ধ ছিল না, হোম-ভিত্তিক উৎপাদনেও ব্যাপকভাবে শিশুদের কাজে লাগানো হতো। ইউরোপ ও আমেরিকায় গৃহ-ভিত্তিক শিল্পে শিশুদের নিয়োগ দেওয়া হত। সংস্কারকরা যুক্তি দেন, কারখানার শ্রম নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কল্যাণে রাষ্ট্রের ভূমিকা থাকা উচিত। 

অনেক ক্ষেত্রে, কারখানার কাজ গৃহস্থালিতে স্থানান্তরিত হয়। পরিবার, বিশেষত নারীরা, এটি পছন্দ করত কারণ এটি তাদের গৃহস্থালির দায়িত্ব পালন করার পাশাপাশি আয়ের সুযোগ দিত। গৃহ-ভিত্তিক উৎপাদন সারা বছর ধরে চলত। বহু পরিবার ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের সন্তানদের এসব আয় সৃষ্টিকারী কাজে অন্তর্ভুক্ত করত। 

কিছু ক্ষেত্রে পুরুষরাও বাড়িতে কাজ করতেন। ফ্রান্সে গার্মেন্টস শ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য অংশ বাড়ি থেকে কাজ করত। জার্মানিতে, ফুল-টাইম হোম অপারেশনের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও লক্ষাধিক পরিবার সপ্তাহে সাত দিন, সারা বছর পণ্য উৎপাদনে নিযুক্ত থাকত। ৫-১৪ বছর বয়সী শিশুরাও বাবা-মায়ের সঙ্গে কাজ করত। 

অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, অস্ট্রিয়া এবং অন্যান্য দেশেও গৃহ-ভিত্তিক শিশুশ্রম সাধারণ ছিল। গ্রামীণ এলাকাগুলোতে শিশুরা কৃষিকাজে নিয়োজিত থাকত। ১৯৪৬ সালে, শ্রম বিশেষজ্ঞ ফ্রিডা এস. মিলার আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থায় (আইএলও) উল্লেখ করেন, এই গৃহ-ভিত্তিক শিল্পগুলোতে নিম্ন মজুরি, দীর্ঘ কাজের সময়, শিশুশ্রম এবং অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ ছিল।

৩.৩.২. গ্রামীণ এলাকায় শিশুশ্রম

গ্রামীণ অঞ্চলে শিশুশ্রম আরও ভিন্ন আকারে দেখা যেত। সেখানকার পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের কৃষিকাজে নিয়োজিত করত। জমি চাষ, ফসল কাটা, গবাদি পশুর দেখাশোনার মতো কাজে শিশুরা পরিবারকে সহায়তা করত। যদিও এটি অনেক সময় পরিবারের জন্য অর্থনৈতিক স্বস্তি আনত কিন্তু শিশুর শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে এর বিরূপ প্রভাব পড়ত।

বিশ শতকের গোড়ায় শিশুশ্রম বন্ধ করার জন্য বিভিন্ন আন্দোলন ও সংস্কার উদ্যোগ দেখা যায়।

  • জাতীয় শিশু শ্রম কমিটি (NCLC): যুক্তরাষ্ট্রে গঠিত এই সংস্থাটি শিশু শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়ন এবং শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করার জন্য কাজ করে।
  • লুইস হাইনের ফটোগ্রাফি: হাইনের ছবিগুলো শিশু শ্রমিকদের কঠোর বাস্তবতাকে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরে এবং সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করে।
  • আইন প্রণয়ন: ১৯৩৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে "ফেয়ার লেবার স্ট্যান্ডার্ডস অ্যাক্ট" পাস হয় যা শিশুদের কাজের সময় ও বয়সসীমা নির্ধারণ করে।

৩.৪. ২১ শতকের প্রাক্কালে 

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে শিশুশ্রম একটি সাধারণ ঘটনা। ৫-১৭ বছর বয়সী শিশুদের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে জড়িত থাকার হিসাব অনুযায়ী, শিশুশ্রমের সংখ্যা ২৫০ থেকে ৩০৪ মিলিয়নের মধ্যে পরিবর্তিত হয়। 

হালকা এবং মাঝে মাঝে কাজের বিষয়টি বাদ দিলে, আইএলও (ILO) ২০০৮ সালে ৫-১৪ বছর বয়সী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৫৩ মিলিয়ন বলে অনুমান করেছে যা ২০০৪ সালের তুলনায় প্রায় ২০ মিলিয়ন কম। 

এই শিশু শ্রমিকদের মধ্যে ৬০ শতাংশই কৃষি কার্যক্রম যেমন কৃষিকাজ, দুগ্ধ উৎপাদন, মৎস্য এবং বনায়নে নিয়োজিত ছিল। আরও ২৫ শতাংশ খুচরা ব্যবসা, পণ্য পরিবহন, রেস্তোরাঁয় কাজ, আবর্জনা বাছাই, পুনর্ব্যবহার, জুতা পালিশ এবং গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত ছিল। বাকি ১৫ শতাংশ শিশু শ্রমিক অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি, গৃহভিত্তিক উদ্যোগ, কারখানা ও খনিতে কাজ করেছে। 

তিনজন শিশুশ্রমিকের মধ্যে দুইজনই অবৈতনিক পারিবারিক কাজে নিযুক্ত, যেখানে তারা পিতামাতার সহায়তায় কাজ করে। কিছু শিশু পর্যটকদের জন্য গাইড হিসেবে কাজ করে এবং দোকান বা রেস্তোরাঁয় ব্যবসা আনতে সাহায্য করে। শিশু শ্রম সাধারণত গ্রামীণ অঞ্চলে বেশি (৭০ শতাংশ) এবং শহরের অনানুষ্ঠানিক খাতে (২৬ শতাংশ) ঘটে। 

জনমনে প্রচলিত ধারণার বিপরীতে, বেশিরভাগ শিশু শ্রমিক উৎপাদন বা আনুষ্ঠানিক অর্থনীতিতে নয় বরং তাদের পরিবারের সাথে কাজ করে। ৫-১৪ বছর বয়সী শিশু শ্রমিকদের মধ্যে ৩ শতাংশেরও কম তাদের পরিবারের বাইরে কাজ করে। এশিয়ায় শ্রমশক্তির ২২ শতাংশ, আফ্রিকায় ৩২ শতাংশ, ল্যাটিন আমেরিকায় ১৭ শতাংশ এবং উন্নত দেশগুলোতে মাত্র ১ শতাংশ শিশু শ্রমিক রয়েছে। 

আফ্রিকায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা সর্বাধিক যেখানে প্রায় ৬৫ মিলিয়ন শিশু শ্রমিক রয়েছে। তবে জনসংখ্যার কারণে এশিয়ায় এই সংখ্যা ১১৪ মিলিয়নের বেশি। ল্যাটিন আমেরিকায় ১৪ মিলিয়ন শিশু শ্রমিক পাওয়া যায়। কিছু দেশে, শিশুশ্রম সংক্রান্ত সঠিক তথ্য পাওয়া কঠিন। 

উদাহরণস্বরূপ, চীনে শিশুশ্রমের তথ্য সরকার অত্যন্ত গোপন হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করেছে যা সঠিক পরিসংখ্যান পেতে বাধা সৃষ্টি করে। চীন শিশুশ্রম নিরোধে আইন প্রণয়ন করলেও কৃষি, পরিষেবা খাত এবং ছোট কর্মশালায় শিশুশ্রম একটি চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। 

২০১২ সালের ম্যাপলক্রফট চাইল্ড লেবার ইনডেক্স অনুযায়ী, ৭৬টি দেশে শিশুশ্রম সমস্যা উচ্চ মাত্রায় ঝুঁকিপূর্ণ। মিয়ানমার, উত্তর কোরিয়া, সোমালিয়া এবং সুদানের মতো দেশগুলো এই তালিকার শীর্ষে রয়েছে। এছাড়াও, ভারত, চীন, ফিলিপাইন এবং ইন্দোনেশিয়া উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে শিশুশ্রম ঝুঁকির মুখে রয়েছে।

১৮ শতকের শেষের দিকে এবং ১৯ শতকের শুরুতে শিল্প বিপ্লবের মাধ্যমে শিশুশ্রম ব্যাপক আকারে বেড়ে যায়। ইউরোপ এবং আমেরিকার কারখানাগুলোতে সস্তা শ্রমশক্তি হিসেবে শিশুদের ব্যবহার করা শুরু হয়। এই সময়ে শিশুরা খুব কম মজুরিতে কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করত যেমন কারখানা, খনি এবং তাঁতকল। 

দৈনিক কাজের সময় ছিল ১২-১৬ ঘণ্টা। শিক্ষার সুযোগ কম থাকায় এবং দরিদ্র পরিবারে বাড়তি আয়ের প্রয়োজনের কারণে শিশুশ্রম একটি সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

৪. শিশু শ্রমের কারন

শিশুশ্রম ও তার প্রতিকার রচনা বলতে গেলে এর কারন সম্পর্কে জানা আমাদের অতি জরুরি। শিশু শ্রমের কারণগুলো সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিভিন্ন দিকের ওপর নির্ভর করে। নিম্নলিখিত কারণগুলো শিশু শ্রমের মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে

৪.১. দারিদ্র্য 

দারিদ্র্য শিশুশ্রমের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়, বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলিতে। যখন একটি পরিবার আর্থিক সংকটে থাকে তখন তারা তাদের সন্তানদের অর্থ উপার্জনের জন্য কাজে পাঠানোর দিকে প্রবণ হয়। 

স্কুলে পাঠানোর মতো শিক্ষাগত সুযোগের অভাব, পরিবারের প্রয়োজনীয়তা পূরণের জন্য শ্রমের প্রয়োজনীয়তা এবং সাধারণত অভিভাবকদের দুর্বল আর্থিক পরিস্থিতি শিশুশ্রমে জড়িয়ে ফেলার প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়ায়। দারিদ্র্যের কারণে, অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় খরচ বহন করতে সক্ষম হয় না। 

এমন পরিস্থিতিতে, শিশুরা তাদের পরিবারের আর্থিক বোঝা কমানোর জন্য কাজে নিযুক্ত হয়। এছাড়া, কম বেতনের আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কাজ, যেমন কৃষি বা ছোটখাটো দোকানদারি, শিশুদের জন্য গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। 

এতে শিশুরা শারীরিকভাবে পরিশ্রমী কাজ করে এবং প্রয়োজনীয় অর্থ আয় করে কিন্তু এটি তাদের শারীরিক ও মানসিক উন্নয়নে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে।আইএলও (International Labour Organization) এবং ইউনিসেফ (UNICEF) এর মতো সংস্থাগুলি বারবার উল্লেখ করেছে যে দারিদ্র্য শিশুশ্রমের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় উদ্দীপক শক্তি। 

তাদের রিপোর্টে দেখা গেছে যে বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি শিশুশ্রম সাধারণত উন্নয়নশীল দেশগুলিতে দেখা যায়, যেখানে অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং শিক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা দারিদ্র্য এবং শিশুশ্রমের মধ্যে একটি ঘূর্ণন সৃষ্টি করে।এছাড়া, দারিদ্র্য শুধু শিশুশ্রমের সরবরাহ বৃদ্ধির কারণ নয়, এটি চাহিদাও বাড়ায়। 

যেমন, অভিভাবকদের যদি উপার্জনের জন্য কাজ করতে না হয়, তবে তারা তাদের সন্তানদের কাজে পাঠানোর প্রয়োজন অনুভব করেন। এর ফলে, শিশুশ্রমের প্রবণতা আরো জোরালো হয়ে ওঠে যা একটি দুষ্টচক্র সৃষ্টি করে এবং দারিদ্র্যকে আরও দৃঢ় করে। 

এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি, দারিদ্র্য দূরীকরণের উদ্যোগ এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণের মতো ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৪.২. মানসম্মত শিক্ষার অভাব

মানসম্মত শিক্ষার অভাব শিশুশ্রমের একটি অন্যতম প্রধান কারণ। অনেক দেশে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলিতে, শিক্ষা ব্যবস্থা অপ্রতুল বা অপ্রচলিত। এতে, শিশুদের জন্য স্কুলে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে এবং তাদের ভবিষ্যৎ উন্নয়ন ও সাফল্যের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন সম্ভব হয় না।

শিক্ষার অভাবের ফলে শিশুশ্রমের প্রবণতা আরও বেড়ে যায়। অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের কাজের জন্য পাঠায় কারণ তারা মনে করে যে শিক্ষার কোনও ভবিষ্যৎ নেই, বিশেষ করে যখন তাদের আর্থিক পরিস্থিতি খুবই খারাপ। শিশুরা তখন প্রাথমিকভাবে কাজের মাধ্যমে পরিবারের আর্থিক চাহিদা পূরণ করতে সহায়ক হিসেবে কাজ করে।

অনেক ক্ষেত্রেই, স্কুলের দূরত্ব, শিক্ষকদের অভাব, শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর অভাব এবং অন্য শিক্ষা সম্পর্কিত খরচের কারণে শিশুরা শিক্ষা গ্রহণে ব্যর্থ হয় যা তাদের কর্মশক্তির বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। এমনকি অনেক দেশে, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, পরিবারের অবস্থা এবং সাংস্কৃতিক কাঠামো শিক্ষার থেকে শ্রমকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। 

এ পরিস্থিতিতে, স্কুলে পাঠানোর তুলনায় শিশুকে কাজে পাঠানো সহজ বিকল্প হয়ে দাঁড়ায়। বিশ্বব্যাপী এই সমস্যা কমানোর জন্য, শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি, স্কুলে উপস্থিতি নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন প্রণোদনা এবং দারিদ্র্য কমানোর উদ্যোগগুলো অত্যন্ত জরুরি। 

বিশ্বব্যাংক এবং ইউনিসেফ সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি উল্লেখ করেছে যে, শিক্ষার সুযোগ এবং মানসিক উন্নয়ন শিশুদের দীর্ঘমেয়াদী উন্নতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং এটি শিশুশ্রম কমাতে সহায়ক হবে। তবে, মানসম্মত শিক্ষার অভাব শুধু দেশীয়ভাবে নয়, বৈশ্বিকভাবেও একটি মহামারি আকারে বৃদ্ধি পাচ্ছে যা শিশুশ্রমের বিস্তারকে জোরালো করছে। 

৪.৩. সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারণা

শিশু শ্রমের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারণাগুলি একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করে যা অনেক দেশের পারিবারিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোর মধ্যে গভীরভাবে প্রোথিত। বিভিন্ন সংস্কৃতিতে, শিশুশ্রমকে অনেক সময় নৈতিক বা সামাজিক দায়িত্ব হিসেবে দেখা হয় যা শিশুদের বড় করার প্রক্রিয়ার একটি অংশ। 

অনেক সমাজে এটি একটি সাধারণ ধারণা যে, শিশুদের কাজ করা উচিত, বিশেষ করে যদি তা পরিবারকে সহায়তা করার জন্য হয়। এই ধারণা অনেক পুরনো ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতির মধ্যে বিস্তার লাভ করেছে যেখানে শিশুরা তাদের পিতামাতার পেশার পথ অনুসরণ করে এবং তাদের হাতে থাকা কাজ শেখে। 

এই ধরণের সামাজিক কাঠামোতে, শিশুদের কাজ শেখার মাধ্যমে তাদের চরিত্র গঠন এবং আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায় বলে মনে করা হয়। কিছু দেশে, বিশেষ করে গ্রামীণ বা নিম্নবিত্ত পরিবারের মধ্যে, শিশুশ্রমকে কখনো কখনো একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হিসেবে গৃহীত করা হয়, যেখানে শিশুরা তাদের পিতামাতার সাহায্য করে, বিশেষত কৃষি কাজে। 

এটি ঐতিহ্যগতভাবে সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে শিশুদের শ্রমকে এক ধরনের সমাজে সম্মানিত ভূমিকা হিসেবে দেখানো হয়। অনেক সমাজে, মেয়েদের শিক্ষার চেয়ে গার্হস্থালীন কাজের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া হয়। 

ফলে, মেয়েরা একদিকে যেমন বাড়ির কাজ করতে পাঠানো হয়, তেমনি তারা বাড়ির বাইরে কাজের জন্যও অনুপ্রাণিত হয, যেমন হোস্টেল বা হোটেলে কাজ করা, যার ফলে শিশুশ্রমের হার বাড়ে।এ ধরনের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারণাগুলি শিশুদের প্রতি সহানুভূতি এবং সমবেদনার অভাব সৃষ্টি করতে পারে, যা শিশুশ্রমের ব্যাপক বিস্তারে অবদান রাখে। 

এজন্য সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মনোভাবের পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যাতে শিশুশ্রমের বদলে শিশুদের জন্য শিক্ষার এবং উন্নতির পথ উন্মুক্ত করা যায়।

৪.৪. প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন

প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ু পরিবর্তনও শিশু শ্রমের এক গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করে। এই সমস্যাগুলি বিশেষত দরিদ্র দেশগুলিতে আরও ব্যাপক প্রভাব ফেলছে, যেখানে পরিবারগুলো মূলত কৃষিকাজ বা খামারি কাজের ওপর নির্ভরশীল। 

প্রাকৃতিক দুর্যোগ (যেমন বন্যা, ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়) এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই পরিবারগুলির জীবিকা ও অর্থনৈতিক অবস্থা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ফলে, অনেক শিশুকে পরিবারের আয় বৃদ্ধি করার জন্য কাজে পাঠানো হয়, যাতে তারা আয় করতে পারে এবং পরিবারের সংকট মোকাবেলা করতে সহায়ক হতে পারে।

  • জলবায়ু পরিবর্তন এবং শিশু শ্রম: জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি উৎপাদনে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যেমন মরুভূমি সৃষ্টি, খরা, বন্যা বা দীর্ঘমেয়াদী অনাবৃষ্টি। এতে আবাদি জমির ক্ষতি হয় এবং কৃষকদের জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। যে পরিবারগুলি কৃষির ওপর নির্ভরশীল, তাদের জন্য এটি একটি আয় উপার্জনের উৎস বন্ধ হওয়ার সমান। এর ফলে, অনেক শিশু তাদের পরিবারকে সহায়তা করার জন্য কাজ করতে বাধ্য হয় এবং এটি শিশুশ্রমের একটি অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
  • প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং শিশু শ্রম: প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, খরা বা ঘূর্ণিঝড়, অনেক সময় গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। এই দুর্যোগের পরে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন বা জীবিকা পুনরুদ্ধারের জন্য অনেক পরিবার একাধিক কাজ করতে বাধ্য হয়। দুর্যোগের ফলে যে কাজের সুযোগগুলো কমে যায় বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেগুলির কারণে শিশুরা তাদের পিতামাতার সঙ্গে কাজ করতে বাধ্য হয়, যার ফলে শিশু শ্রম বাড়ে।

এ ধরনের পরিস্থিতিতে শিশুশ্রম শুধু এক ধরনের অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা নয় বরং একটি জীবনের টিকে থাকার সংগ্রাম হয়ে দাঁড়ায়। জলবায়ু পরিবর্তন ও সাপ্রাকৃতিক দুর্যোগ শিশুদের জন্য শিক্ষা, নিরাপত্তা এবং সুস্থ জীবনযাপন লাভের পথগুলোকে আরও কঠিন করে তোলে, তাদের ভবিষ্যতের উন্নতির সম্ভাবনাকে সংকুচিত করে দেয়।

৪.৫. সংঘর্ষ ও স্থানচ্যুতি

সংঘর্ষ ও স্থানচ্যুতি শিশুশ্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করে। সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলগুলি, বিশেষত যেখানে গৃহযুদ্ধ বা জাতিগত সংঘর্ষ চলছে, সেখানকার শিশুরা অত্যন্ত ঝুঁকিতে থাকে। 

এই ধরনের পরিবেশে, পরিবারগুলি তাদের জীবিকা অর্জন করতে এবং বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ বা সংঘর্ষের সাথে জড়িত হতে বাধ্য হয় ফলে, শিশুরা পরিবারের আয়ের উৎস হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়, যেমন সৈন্য হিসেবে জড়িত হওয়া বা অনানুষ্ঠানিক শ্রমের কাজে নিযুক্ত হওয়া।

  • সংঘর্ষের প্রভাব: গৃহযুদ্ধ বা সংঘর্ষের কারণে সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। শিক্ষার সুযোগ সীমিত হয়ে যায় এবং অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের জীবিকার জন্য কাজ করতে প্রেরণ করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে শিশুদের সুরক্ষা বা শিক্ষার ব্যবস্থা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারা প্রায়শই দুর্বল শ্রম বাজারে কাজ করতে বাধ্য হয়, বিশেষ করে অনানুষ্ঠানিক খাতে, যেমন কৃষি, গার্হস্থ্য কাজ এবং বাণিজ্যিক ক্ষেত্র।
  • স্থানচ্যুতি: স্থানচ্যুতি বা শরণার্থী হওয়া অনেক শিশুর জন্য অত্যন্ত বিপদজনক। যুদ্ধ বা সংঘর্ষের কারণে যারা স্থানচ্যুত হয় তারা পরিবারসহ অনেক সময় শিবিরে আশ্রয় নেয় যেখানে শিশুদের শ্রম ব্যবহারের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। স্থানচ্যুতির ফলে, শিশুরা সাধারণত শিক্ষার অভাবে পড়ে এবং অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করতে বাধ্য হয়, যেহেতু তাদের পরিবারের কাছে আর্থিক সহায়তার অভাব থাকে।

এই সমস্ত কারণের ফলস্বরূপ, শিশু শ্রমের হার বৃদ্ধি পায় যা তাদের শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। শিশুশ্রম একটি বহুমাত্রিক সমস্যা যা বিভিন্ন অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক কারণে বাড়ছে এবং সংঘর্ষ ও স্থানচ্যুতি এই সমস্যার অন্যতম মূল কারণ।

৪.৬. নৈতিক কর্মসংস্থানের অভাব

নৈতিক কর্মসংস্থানের অভাব শিশুশ্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে কাজ করে। শিশুরা যখন উপযুক্ত কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় তখন তারা অস্বাভাবিক এবং অনৈতিক কাজের দিকে আকৃষ্ট হতে পারে। 

একটি সমাজে যখন বৈধ, ন্যায্য এবং মানবিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত বা অনুপস্থিত থাকে, তখন শিশুরা তাদের পরিবারের আর্থিক চাহিদা পূরণের জন্য অন্যত্র শ্রমের জন্য চলে আসে।

  • অনৈতিক কর্মসংস্থান: অনেক ক্ষেত্রে, শিশুরা শ্রমের বাজারে প্রবেশ করার সময় শোষণমূলক পরিস্থিতিতে পড়ে। তাদের কাজের সময়কাল অত্যন্ত দীর্ঘ হতে পারে এবং তারা খুব কম মজুরি পায়। এই শ্রম সাধারণত ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে হয়, যেমন উৎপাদনশীল খাত, যেখান থেকে তারা মানসিক ও শারীরিক ক্ষতির শিকার হয়। এই ধরনের কাজগুলো শিশুদের সঠিকভাবে শিখতে, বেড়ে উঠতে এবং সামাজিকভাবে বিকশিত হতে বাধা দেয়।
  • মানবাধিকার লঙ্ঘন: নৈতিক কর্মসংস্থানের অভাবের কারণে, শিশুরা অনেক সময় এমন কাজের দিকে ধাবিত হয় যেখানে তাদের মৌলিক অধিকার, যেমন শিক্ষা লাভ, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ এবং শারীরিক এবং মানসিক সুরক্ষা প্রদান করা হয় না। উদাহরণস্বরূপ, তারা প্রায়শই কৃষি ক্ষেত্র, গার্হস্থ্য সেবা বা কারখানায় কাজ করে যেখানে তাদের শ্রমের শর্তাবলী খারাপ এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই।
  • কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব: নৈতিক এবং ন্যায্য কর্মসংস্থানের অভাব শিশুদের একটি বিপজ্জনক পরিপ্রেক্ষিতে ঠেলে দেয় যেখানে তারা সঠিক বিকাশের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এতে সমাজের আর্থিক বৈষম্য এবং শিশু শ্রমের প্রবণতা আরও তীব্র হয় যা অবশেষে তাদের ভবিষ্যতকেও হুমকির মুখে ফেলে।

এছাড়াও, শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং আইন প্রচেষ্টা করছে, যাতে শিশুরা নিরাপদ এবং নৈতিক কাজের সুযোগ পায় এবং তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়।

৪.৭. সাংস্কৃতিক কারণ

ইউরোপীয় ইতিহাস এবং আধুনিক যুগের সমসাময়িক শিশুশ্রমে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঐতিহাসিকভাবে, কাজকে শিশুদের নৈতিকতা উন্নয়ন এবং দক্ষতা অর্জনের একটি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে দেখা হতো। এটি বিশ্বাস করা হতো যে কাজের মাধ্যমে শিশুদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা যায় এবং এই ধারণা অনেক সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল।

বিশেষ করে যেখানে অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতি এবং ক্ষুদ্র পারিবারিক ব্যবসা প্রাধান্য পায়, সেখানে শিশুদের কাজ পারিবারিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। তাদের পিতামাতার পেশা অনুসরণ করার মাধ্যমে তারা সেই ব্যবসার কৌশল এবং দক্ষতা অর্জন করে।

অনেক সংস্কৃতিতে, বিশেষত যেখানে নারীদের শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব কম, মেয়েরা আনুষ্ঠানিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এর পরিবর্তে তারা গার্হস্থ্য কাজ এবং অন্যান্য শিশুশ্রমে যুক্ত হয়। এই ধরনের প্রথাগত বিশ্বাস শিশুশ্রমকে বৈধতা দেয় এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এটি চালু রাখে।

শিশুশ্রম কমানোর জন্য এই সাংস্কৃতিক বিশ্বাসগুলোর পরিবর্তন এবং সচেতনতা বাড়ানো জরুরি যাতে শিশুদের জন্য শিক্ষার অধিকার এবং স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা যায়। শিশু শ্রমের এই মূল কারণগুলো নিরসনের জন্য দরিদ্রতা হ্রাস, মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করা এবং সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ প্রয়োজন​  

৪.৮. সামষ্টিক অর্থনীতি

বিগেরি এবং মেহরোত্রা তাদের গবেষণায় ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড এবং ফিলিপাইনসহ পাঁচটি এশিয়ান দেশের শিশুশ্রমের ওপর আলোকপাত করেছেন। তারা উল্লেখ করেন যে এই দেশগুলোতে শিশুশ্রম একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা যা নতুন নয়। তাদের মতে, শিশুশ্রমকে প্রভাবিত করে এমন সামষ্টিক অর্থনৈতিক কারণগুলি চাহিদা ও সরবরাহ উভয় দিক থেকেই কাজ করে। 

সরবরাহের দিক থেকে, দারিদ্র্য এবং মানসম্মত শিক্ষার অভাব শিশুশ্রমকে উৎসাহিত করে। অনেক অভিভাবক তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠানোর পরিবর্তে কাজে পাঠাতে বাধ্য হন, বিশেষত যেখানে শিক্ষার সুযোগ সীমিত। অন্যদিকে চাহিদার ক্ষেত্রে, আনুষ্ঠানিক উচ্চ বেতনের অর্থনীতির পরিবর্তে কম বেতনের অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির সম্প্রসারণ শিশুশ্রমের চাহিদা বাড়ায়। 

এই অর্থনীতিগুলোর মধ্যে সাধারণত স্বল্প দক্ষ শ্রমের প্রয়োজন হয় যা শিশুদের সহজে নিযুক্ত করার প্রবণতা বাড়ায়। অন্য পণ্ডিতরা এও উল্লেখ করেন যে শ্রমবাজারের অনমনীয়তা, অনানুষ্ঠানিক অর্থনীতির উচ্চ প্রভাব, শিল্পের আকার বৃদ্ধির অক্ষমতা এবং আধুনিক প্রযুক্তির অভাব শিশুশ্রমের গ্রহণযোগ্যতাকে বাড়িয়ে তোলে। 

এই সমস্ত সামষ্টিক অর্থনৈতিক উপাদান একত্রে শিশুশ্রম সমস্যাকে আরও গভীর করে তোলে এবং এর সমাধানে জোরালো নীতি প্রয়োজন। এই দৃষ্টিকোণগুলো দেখায় যে শিশুশ্রম শুধুমাত্র দারিদ্র্যের ফল নয় এটি অর্থনৈতিক কাঠামো এবং সামাজিক প্রথার ওপরও নির্ভরশীল।

৫. বাংলাদেশে শিশুশ্রম

শিশুশ্রম ও তার প্রতিকার রচনা বলতে গেলে বাংলাদেশে এর পরিস্থিতি কেমন তা বর্ণনা করা দরকার। শিশুশ্রম বাংলাদেশে একটি বহুল প্রচলিত সমস্যা, যেখানে ৫ থেকে ১৪ বছর বয়সী প্রায় ৪.৭ মিলিয়ন শিশু শ্রমের শিকার হয়। 
বাংলাদেশে শিশুশ্রম
এই শিশু শ্রমের ৮৩ শতাংশ গ্রামীণ অঞ্চলে এবং ১৭ শতাংশ শহরাঞ্চলে ঘটছে। শিশুশ্রম বিভিন্ন খাতে ছড়িয়ে পড়েছে, যেমন কৃষি, হাঁস পালক, মাছ প্রক্রিয়াকরণ, গার্মেন্টস, চামড়া শিল্প এবং জুতা উৎপাদন। 

শিশুদের পাট প্রক্রিয়াজাতকরণ, মোমবাতি, সাবান এবং আসবাবপত্র উৎপাদনের কাজে নিয়োগ করা হয়, পাশাপাশি লবণ শিল্প, অ্যাসবেসটস উৎপাদন, পিচ, টাইলস এবং জাহাজ ভাঙ্গার কাজেও তারা কাজ করে। ২০০৬ সালে বাংলাদেশ একটি শ্রম আইন পাস করে, যেখানে শিশুদের জন্য কর্মসংস্থানের ন্যূনতম বয়স ১৪ বছর নির্ধারণ করা হয়। 

তবে, এই আইন বাস্তবায়ন দুরূহ কারণ দেশে শতকরা ৯৩ ভাগ শিশুশ্রমিক অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করছে যেমন ছোট কারখানা, কর্মশালা, রাস্তায়, গৃহভিত্তিক ব্যবসা এবং গার্হস্থ্য কর্মসংস্থানে। বাংলাদেশে শিশুশ্রম ব্যাপক হলেও, সরকার শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। 

উদাহরণস্বরূপ, দেশটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) এর C182 কনভেনশনে স্বাক্ষর করেছে যা শিশুশ্রমের সবচেয়ে খারাপ রূপগুলোর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। এছাড়া, বাংলাদেশ জাতিসংঘের কনভেনশন অন দ্য রাইটস অব চাইল্ড-এও সম্মত হয়েছে।

৬. বাংলাদেশে শিশুশ্রমিকের জীবনমান

শিশুশ্রমিকদের জীবনমান বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ, গভীরভাবে অনুভূত সমস্যা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত গ্রামীণ এলাকায়, শিশুশ্রমের হার এখনও যথেষ্ট উচ্চ, যেখানে শিশুদের জীবিকা অর্জনের জন্য কাজ করতে হয়। 

এই সমস্যা মূলত একটি উন্নয়ন সম্পর্কিত বিষয় যেখানে বহু শিশুর পরিবারকে জীবিকা নির্বাহের জন্য শিশুদের কাজে পাঠাতে হয় কারণ তাদের আয়ের ওপর নির্ভরশীলতা অনেকটাই বেশি। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে, শিশুশ্রমের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে গরিবি এবং সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব। 

শিশুদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষা নিশ্চিত করা না হলে, তারা কাজে নিযুক্ত হয়ে যায় যা তাদের শারীরিক এবং মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে, সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারছে তবে এটি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা অনেক কঠিন। 

উদাহরণস্বরূপ, তৈরি পোশাক শিল্পে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে একটি সফল উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, যেখানে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো একযোগে কাজ করে সফলভাবে শিশুশ্রম হ্রাস করতে পেরেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে শিশুশ্রম বন্ধ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) এর কনভেনশন ১৩৮ গ্রহণ করেছে যা সরকারের একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও বাস্তবায়নে ব্যাপক সহযোগিতা এবং সামগ্রিক উন্নয়নের প্রয়োজন। 

এটি কেবল আইনি পদক্ষেপের মাধ্যমে সম্ভব নয় বরং সমগ্র সমাজের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে।​ এই সমস্যার সমাধান করতে একটি সামগ্রিক উন্নয়ন নীতি গ্রহণ করতে হবে যেখানে শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তা এবং দক্ষতা বৃদ্ধি সহ বিভিন্ন উপাদান একত্রিত হবে যাতে শিশুদের কাজ করার পরিবর্তে শিক্ষার সুযোগ পায়। 

৭. বাংলাদেশে শিশুশ্রমের কারণ

বাংলাদেশে শিশুশ্রম একটি বহুমুখী সমস্যা যা মূলত আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে সৃষ্ট। দারিদ্র্য, শিক্ষা সুযোগের অভাব এবং সামাজিক অসচেতনতা শিশুশ্রমের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। তবে এগুলো ছাড়াও আরও বেশ কিছু কারণ সম্পর্কেও বলা হবে, 

৭.১. দারিদ্র্য

এটি শিশুশ্রমের প্রধান কারণ। দরিদ্র পরিবারের জন্য শিশুদের কাজ করা জীবিকার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপায়। মাথাপিছু আয়ের বৃদ্ধি শিশুশ্রম হ্রাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে শিশুশ্রম ও তার প্রতিকার এর ক্ষেত্রে মাথাপিছু আয় ৫০০-১০০০ ডলারে উন্নীত হলে শিশুশ্রমের হার ৩০%-৬০% থেকে ১০%-৩০% কমতে পারে।

ইউনিসেফের ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে। আনুমানিকভাবে দেশের ২০-২৫% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে জীবনযাপন করছে। পরিবারগুলোর আর্থিক সংকট শিশুদের কাজ করতে বাধ্য করে।শহুরে এলাকায় জীবিকার সুযোগ বৃদ্ধি পেলে গ্রাম থেকে শহরে জনসংখ্যা স্থানান্তর ঘটে। 

এটি শহুরে দরিদ্র জীবনযাত্রা এবং শিশুশ্রমকে স্থায়ী করে। অনেক ক্ষেত্রে, অভিভাবকহীন বা পরিত্যক্ত শিশুরা নিজের জীবিকা নির্বাহের জন্য কাজ করতে বাধ্য হয়। দরিদ্র পরিবারে শিশুদের পারিবারিক আয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে হয়। এই চক্র ভাঙার জন্য আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন ILO ও জাতিসংঘ দারিদ্র্য নিরসনের ওপর জোর দিচ্ছে, যা শিশুশ্রম কমাতে সহায়ক হতে পারে।

৭.২. শিক্ষা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা

বাংলাদেশে শিশুশ্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হিসেবে শিক্ষা ব্যবস্থার অপ্রতুলতা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। শিক্ষা ব্যবস্থা দুর্বল হলে শিশুরা স্কুলে যাওয়ার পরিবর্তে শ্রমবাজারে যুক্ত হতে বাধ্য হয়। এই সমস্যার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • শিক্ষার খরচ এবং অভিগম্যতার অভাব: দরিদ্র পরিবারগুলো প্রায়শই স্কুলের ফি, ইউনিফর্ম, বই এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বহন করতে পারে না। ফলে শিশুরা বাধ্য হয় শিক্ষার পরিবর্তে কাজে যোগ দেয় যাতে তারা পরিবারকে আর্থিকভাবে সহায়তা করতে পারে। 
  • মানসম্পন্ন শিক্ষার অভাব: অনেক ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষার মান যথেষ্ট উন্নত নয়। ফলে অভিভাবকরা শিশুকে স্কুলে পাঠানোর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না। একইসাথে, বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ যদি আকর্ষণীয় না হয় তবে শিশুরা পড়াশোনায় উৎসাহ হারায়।
  • স্কুলে পড়াশোনার সুযোগের অভাব: বিশেষ করে প্রত্যন্ত এলাকায় স্কুলের সংখ্যা কম এবং শিক্ষকের অভাব রয়েছে। ফলে অনেক শিশু বিদ্যালয়ের সুযোগ পায় না এবং শ্রমে জড়িয়ে পড়ে।
  • কারিগরি শিক্ষার অভাব: শিশুশ্রম অনেক সময় কারিগরি দক্ষতার অভাবে ঘটে। যদি শিক্ষার্থীদের প্রারম্ভিক পর্যায় থেকেই কারিগরি শিক্ষা দেওয়া হতো তবে তারা কাজের চাহিদার সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের উপযুক্ত করতে পারত।
  • প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার অভাব: শিশুশ্রম নিরসনে বিদ্যমান আইন কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অভাব রয়েছে। পাশাপাশি, দরিদ্র পরিবারগুলোকে শিক্ষার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করার মতো কার্যকর উদ্যোগও সীমিত।

শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে এবং মানসম্পন্ন শিক্ষার ব্যবস্থা শিশুশ্রম কমানোর একটি কার্যকর উপায় হতে পারে। UNICEF ও ILO-এর মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ সমস্যার সমাধানে সচেতনতা ও নীতি নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

৭.৩. সামাজিক অসচেতনতা

বাংলাদেশে শিশুশ্রমের অন্যতম একটি কারণ হলো সামাজিক অসচেতনতা। এটি মূলত জনগণের মধ্যে শিশু অধিকার সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব এবং শিশুশ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতার ঘাটতির কারণে ঘটে। এ সমস্যার বিভিন্ন দিক রয়েছে, যেমন:

  • শিশুশ্রমের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা: অনেক পরিবার এবং সমাজের একটি বড় অংশ শিশুশ্রমকে একটি সাধারণ বা স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখে। তারা মনে করে যে শিশুরা কাজ করে পরিবারের অর্থনৈতিক সহায়তা করছে এবং এটি তাদের দায়িত্ব।
  • শিক্ষা ও অধিকার সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব: অনেক অভিভাবক জানেন না যে শিশুদের শিক্ষার অধিকার এবং তাদের কর্মজীবনে যুক্ত হওয়া মানসিক ও শারীরিক বিকাশের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে ফলে শিশুশ্রমের জন্য তারা দায়ী হলেও এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে সচেতন নয়।
  • সংস্কার এবং দৃষ্টিভঙ্গি: কিছু এলাকায় প্রচলিত সামাজিক সংস্কারের কারণে শিশুরা শিক্ষার পরিবর্তে কাজ করতে বাধ্য হয়। অনেক সময় ছেলেদের আয়ের উৎস হিসেবে এবং মেয়েদের গৃহস্থালির কাজে সহায়ক হিসেবে কাজে লাগানো হয়।
  • সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগের অপ্রতুল প্রচারণা: শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে প্রচারণা এবং সচেতনতা কার্যক্রম অনেক এলাকায় পর্যাপ্ত নয় ফলে শিশুশ্রম রোধের জন্য আইন ও নীতিমালা সম্পর্কে জনগণ সচেতন হতে পারে না।
  • অভিভাবকদের আর্থিক নির্ভরশীলতা: দরিদ্র পরিবারগুলোতে শিশুর আয়কে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তারা মনে করে শিশুরা কাজ না করলে তাদের জীবনযাত্রার মান আরও খারাপ হবে।

৭.৪. জীবনধারণের সংকট

বাংলাদেশে শিশুশ্রমের অন্যতম প্রধান কারণ হলো জীবনধারণের সংকট। এটি এমন একটি অবস্থা যেখানে দরিদ্র পরিবারগুলো তাদের ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হয় এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য শিশুদের শ্রমে যুক্ত করতে বাধ্য হয়। জীবনধারণের সংকট কীভাবে শিশুশ্রমকে বাড়িয়ে তোলে তা নিম্নে ব্যাখ্যা করা হলো:
  • পারিবারিক আর্থিক চাপ:  দরিদ্র পরিবারগুলোতে অভিভাবকের আয় প্রায়ই পরিবারের খাদ্য, বাসস্থান এবং চিকিৎসার মতো মৌলিক চাহিদা পূরণে যথেষ্ট হয় না। এই অবস্থায় শিশুরা আয়ের একটি অতিরিক্ত উৎস হয়ে ওঠে। অনেক পরিবার বিশ্বাস করে যে শিশুদের শ্রমে যুক্ত করা ছাড়া তাদের জীবিকা নির্বাহ সম্ভব নয়।
  • খাদ্য নিরাপত্তার অভাব: দরিদ্র পরিবারগুলোতে পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে শিশুরা নিজের এবং পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করে। ইউনিসেফ এবং অন্যান্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশের অনেক পরিবার এখনও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মুখোমুখি। শিশুরা কাজের মাধ্যমে এই সংকট কিছুটা মোকাবিলা করতে চেষ্টা করে।
  • প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং স্থানচ্যুতি: বাংলাদেশে প্রায়শই প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং নদীভাঙন ঘটে। এসব দুর্যোগের ফলে পরিবারগুলো তাদের জীবিকা হারায়। অনেক ক্ষেত্রে এসব পরিবার তাদের সন্তানদের শ্রমবাজারে পাঠাতে বাধ্য হয় যাতে তারা টিকে থাকতে পারে।
  • চরম দারিদ্র্যের চক্র: চরম দারিদ্র্যের কারণে অনেক পরিবার তাদের সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে কাজ করতে পাঠায় এর ফলে শিশুরা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় এবং ভবিষ্যতে আরও নিম্নমানের শ্রমে আবদ্ধ হয় যা দারিদ্র্যের চক্রকে স্থায়ী করে।
  • সরকারি সহায়তার অভাব: দরিদ্র পরিবারগুলো অনেক সময় সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হয়। সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির অপ্রতুলতা ও বাস্তবায়নের ত্রুটি এই সংকটকে আরও গভীর করে।

৭.৫. বাল্যবিবাহ

বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ শিশুশ্রমের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হিসেবে বিবেচিত। বাল্যবিবাহ কেবল একজন শিশুকে শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে না, বরং তাদের বিভিন্ন শ্রমশক্তিতে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য করে। এ সমস্যার ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে নিম্নলিখিত কারণগুলো উঠে আসে,

  • শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হওয়া: বাল্যবিবাহের ফলে মেয়েরা প্রায়ই স্কুল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। বিয়ের পরে তাদের শিক্ষার সুযোগ আর থাকে না এবং তারা গৃহস্থালি কাজ বা স্বামীর সংসারের দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হয়। অনেক মেয়ে অর্থনৈতিক সাহায্যের জন্য শ্রমশক্তিতে যুক্ত হয়।
  • আর্থিক চাপ: দারিদ্র্যের কারণে অনেক অভিভাবক তাদের মেয়েকে বাল্যবিবাহে উৎসাহিত করে, যাতে তারা অর্থ সঞ্চয় করতে পারে। বাল্যবিবাহের পরে মেয়েরা যদি দরিদ্র পরিবারে যায়, তবে সংসারের চাহিদা মেটাতে তাদের কাজ করতে হয়।
  • পারিবারিক সহিংসতা এবং শোষণ: বাল্যবিবাহের শিকার শিশুরা প্রায়ই শারীরিক ও মানসিক শোষণের শিকার হয়। এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার জন্য তারা বিভিন্ন শ্রমে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
  • মেয়েদের আত্মনির্ভরশীলতার অভাব: বাল্যবিবাহের মাধ্যমে মেয়েদের ব্যক্তিগত উন্নতির সুযোগ হারিয়ে যায়। তারা কেবল সংসারের কাজেই সীমাবদ্ধ থাকে এবং কর্মসংস্থান পেতে বাধাগ্রস্ত হয়। অনেক সময় তারা গৃহকর্মী বা স্বল্প দক্ষ শ্রমিক হিসেবে কাজ করে।
  • দারিদ্র্যচক্র স্থায়ী করা: বাল্যবিবাহের ফলে শিশুদের শ্রমশক্তিতে প্রবেশের হার বৃদ্ধি পায়, যা একটি প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে দারিদ্র্যের চক্রকে স্থায়ী করে।

৭.৬. বিচ্ছিন্ন পারিবারিক পরিবেশ

শিশুশ্রম একটি জটিল সামাজিক সমস্যা যার পেছনে বহু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে বিচ্ছিন্ন পারিবারিক পরিবেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পরিবার একটি শিশুর জীবনের ভিত্তি কিন্তু যখন একটি পরিবার ভেঙে যায় বা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখন তা শিশুটির স্বাভাবিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং শিশুশ্রমের দিকে ঠেলে দেয়। নিচে এই বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টগুলো দেওয়া হল-

  • শিক্ষার অভাব: বিচ্ছিন্ন পরিবারের শিশুরা প্রায়ই পড়াশোনা ছেড়ে শ্রমজীবী হয়ে পড়ে। 
  • আবেগগত ভাঙন: পারিবারিক সহিংসতা বা বিচ্ছেদের ফলে শিশুর মানসিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয় এবং তারা শিশুশ্রমে জড়িয়ে পড়ে।
  • পর্যবেক্ষণের অভাব: বাবা-মার বিচ্ছেদের ফলে শিশুদের তত্ত্বাবধান কমে যায় যা তাদের কাজে জড়াতে উৎসাহিত করে।
  • বেঁচে থাকার সংগ্রাম: পারিবারিক বিচ্ছিন্নতার কারণে শিশুদের নিজের খরচ মেটাতে কাজ করতে হয়।
  • সহিংস পরিবেশ থেকে পালানো: পরিবারে সহিংসতা থেকে বাঁচতে শিশুরা শ্রমের মাধ্যমে বিকল্প নিরাপত্তা খোঁজে।
  • সামাজিক চাপ: বিচ্ছিন্ন পরিবারে শিশুশ্রম অনেক সময় সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হিসেবে দেখা হয়।
  • মানসিক আঘাত: পরিবারের ভাঙন শিশুর মানসিক বিকাশে বাধা দেয় যা তাদের কাজে জড়িয়ে ফেলে।
  • প্রভাবশালী প্ররোচনা: অভিভাবকের অবহেলার সুযোগে শিশুরা শ্রমের জন্য অন্যদের দ্বারা প্রলুব্ধ হয়।
  • সমাধানের অভাব: পরিবার পুনর্বাসন বা আর্থিক সহায়তার অভাবে শিশুশ্রম একটি অবশ্যম্ভাবী পথ হয়ে দাঁড়ায়।

৮. শিশুশ্রম রোধ করা প্রয়োজন কেন

শিশুশ্রম রোধ করা অত্যন্ত জরুরি কারণ এটি শুধুমাত্র শিশুদের শারীরিক ও মানসিক উন্নয়ন ব্যাহত করে না বরং একটি দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। শিশুশ্রমের মাধ্যমে শিশুরা শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয় যা তাদের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে। এই সমস্যা সমাধানে নিম্নলিখিত দিকগুলো বিবেচ্য-

  • শিশুদের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন: শিশুশ্রম শিশুদের অধিকার লঙ্ঘন করে এর ফলে তারা সুরক্ষিত শৈশব থেকে বঞ্চিত হয় এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়​। 
  • শিক্ষা থেকে বঞ্চনা: শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুরা স্কুলে যাওয়ার সুযোগ পায় না ফলে তারা শিক্ষার মাধ্যমে নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়তে অক্ষম হয়ে পড়ে। এটি একটি দেশের মানবসম্পদ উন্নয়নে বড় বাধা।
  • দারিদ্র্যের চক্র: শিশুশ্রম শিশুদের একটি নিম্ন আয়ের চাকরি বা শ্রমজীবী জীবনে সীমাবদ্ধ রাখে। এতে দারিদ্র্যের চক্র অব্যাহত থাকে যা একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ব্যাহত করে​।
  • স্বাস্থ্যঝুঁকি: ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত শিশুরা শারীরিক আঘাত, দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতা এবং কখনো কখনো জীবন-হানির সম্মুখীন হয়। এটি তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে বিঘ্নিত করে​।
  • সমাজের প্রতি নেতিবাচক প্রভাব: শিশুশ্রম সমাজে অন্যায্যতার পরিবেশ সৃষ্টি করে এবং একটি জাতির সামগ্রিক নৈতিক মানদণ্ডকে নিচে নামিয়ে আনে​।
  • অপরাধমূলক কার্যকলাপের শিকার হওয়া: শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুরা প্রায়ই মানব পাচার, অবৈধ কাজ এবং বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপের শিকার হয়। এটি তাদের জীবনের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে​। 
  • সামাজিক বৈষম্যের স্থায়িত্ব: শিশুশ্রম সমাজে শ্রেণি বৈষম্যকে আরও দৃঢ় করে তোলে। শ্রমজীবী শিশুরা প্রায়শই নিম্নমানের জীবনযাপন করতে বাধ্য হয় যা সমাজের সমতার ধারণার পরিপন্থী​।
  • দেশের উন্নয়নে বাধা: শিশুশ্রমে নিযুক্ত শিশুরা ভবিষ্যতে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে পারে না। এটি একটি দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে​।
  • শিশুদের সৃজনশীলতা বাধাগ্রস্ত হয়: শিশুশ্রম তাদের সৃজনশীলতা এবং দক্ষতা বিকাশের সুযোগ হ্রাস করে। শৈশবে শারীরিক পরিশ্রম তাদের ভবিষ্যৎ সাফল্যের সম্ভাবনাকে সংকুচিত করে তোলে​।
  • জাতীয় ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন: শিশুশ্রম জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক আইন, যেমন আইএলও কনভেনশন এবং ইউনিসেফের শিশু অধিকার সনদ, লঙ্ঘন করে। এটি বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি দেশের মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করে।

এই কারণগুলো স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয় কেন শিশুশ্রম রোধ করা একটি অগ্রাধিকারমূলক কাজ।

৯. শিশুশ্রমের এর প্রতিকার

শিশুশ্রম মানবতাবিরোধী ও একটি বড় সামাজিক সমস্যা যা দরিদ্রতা, শিক্ষার অভাব, জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং অভিভাবকদের অসচেতনতাসহ নানা কারণে শিকড় গেড়ে বসেছে। শিশুশ্রম শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে, তাদের শিক্ষার অধিকার হরণ করে এবং সমাজে অযোগ্য ও অসুস্থ প্রজন্ম গড়ে তোলে। 

এ সমস্যার সমাধানের জন্য দরকার জনসচেতনতা বৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষার প্রসার এবং শিশু শ্রমিকদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ। শিশুশ্রম ও তার প্রতিকার নিয়ে কাজ করতে হলে সবাইকে একসঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। এই সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য সামাজিক সংগঠন, এনজিও এবং সরকারের উদ্যোগকে আরও কার্যকর করতে হবে। 

শিক্ষার বিকল্প কর্মসূচি এবং শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ ও উন্নত ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা প্রয়োজন। শিশুশ্রম প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপের জন্য নিম্নলিখিত পয়েন্টগুলো বিবেচনা করা যেতে পারে:

  • শিক্ষার প্রসার: বিনামূল্যে এবং বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার মাধ্যমে শিশুশ্রম হ্রাস করা সম্ভব। শিক্ষার মান উন্নয়ন এবং স্কুলে ভর্তির হার বাড়ানো জরুরি। বাংলাদেশে বর্তমানে বাধ্যতামূলক শিক্ষা ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত। এটিকে অন্তত ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত বাড়ানো উচিত​।  
  • আইনি প্রয়োগ জোরদার করা: শ্রম আইন কার্যকর করার পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (ILO) কনভেনশনগুলো মেনে চলার মাধ্যমে শিশুশ্রম নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ILO-এর "Minimum Age Convention" গ্রহণ করেছে যা ১৪ বছরের নিচে শিশুশ্রম নিষিদ্ধ করে​।
  • অর্থনৈতিক সহায়তা বৃদ্ধি: দরিদ্র পরিবারগুলোকে আর্থিক সহায়তা এবং সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি প্রদান করে শিশুশ্রম বন্ধ করা যেতে পারে। এছাড়া, পরিবারের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য কর্মসংস্থান এবং মাইক্রোফিন্যান্স সুবিধা বাড়ানো প্রয়োজন​।
  • জনসচেতনতা বৃদ্ধি: শিশুশ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে গণমাধ্যম, সামাজিক প্রচারাভিযান এবং স্থানীয় সংগঠনের মাধ্যমে উদ্যোগ নেওয়া উচিত। এটি শিশুশ্রম সম্পর্কে মনোভাব পরিবর্তনে সাহায্য করবে​।
  • বিকল্প কর্মসংস্থান ব্যবস্থা: দরিদ্র পরিবারের শিশুদের জন্য কারিগরি শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করে তাদের ভবিষ্যতের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন। এটি শিশুশ্রম কমাতে কার্যকর হতে পারে​। 
  • সরকার-বেসরকারি অংশীদারিত্ব: সরকারের পাশাপাশি এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ILO এবং অন্যান্য সংগঠন বাংলাদেশের শিশুশ্রম হ্রাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে​।
  • ঝুঁকিপূর্ণ কাজ নিষিদ্ধকরণ: শিশুদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কাজ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে এবং এই বিষয়ে কার্যকর তদারকি নিশ্চিত করা জরুরি। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৮ বছরের নিচে ঝুঁকিপূর্ণ কাজ নিষিদ্ধ রয়েছে​। 

এই পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে শিশুশ্রম প্রতিরোধে উল্লেখযোগ্য উন্নতি করা সম্ভব।

লেখকের মন্তব্য

শিশুশ্রম ও তার প্রতিকার রচনায় সর্বশেষ যেটা বলা যায় সেটা হল, শিশুশ্রম একটি জটিল সামাজিক সমস্যা যা দরিদ্রতা, অশিক্ষা এবং সচেতনতার অভাবের কারণে গড়ে উঠেছে। এটি দূর করতে শিক্ষার প্রসার, আইনের কঠোর বাস্তবায়ন এবং দরিদ্র পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান অপরিহার্য। 

জনসচেতনতা বাড়ানো এবং শিশুশ্রমের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে অবগত করে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা সম্ভব। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পারে শিশুশ্রমের মতো সামাজিক ব্যাধি দূর করে শিশুদের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে। 

আপনারা যারা সমাজের উন্নয়নে সচেতন, 'শিশুশ্রম ও তার প্রতিকার রচনা' শিরোনামে আমাদের নতুন কন্টেন্টটি পড়ে মতামত জানান। আপনার মন্তব্য শিশুশ্রম প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির পথে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। মতামত দিতে ভুলবেন না!

ধন্যবাদ
সামরিন ইনফো। 

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

সামরিন ইনফো এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url